বাজারে মেলে না সরকার নির্ধারিত দামের এলপি গ্যাস

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম জুলাই মাসের জন্য ৯৯৯ টাকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তবে এ দামে বাজার থেকে কিনতে পারছেন না ভোক্তারা। খুচরা বিক্রেতাকেই কিনতে হচ্ছে এক হাজার ৫০ থেকে এক হাজার ১০০ টাকা দরে। এর সঙ্গে নিজের মুনাফা যোগ করে বিক্রি করছেন তারা। ডিলার পয়েন্টেও বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে।

ভোক্তা পরিচয়ে ফোন দিলে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার মায়ের দোয়া এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার মো. সোহেল বলেন, ‘দোকান থেকে নিয়ে গেলে ১২ কেজির এলপি গ্যাস নেওয়া হচ্ছে এক হাজার ১০০ টাকা। আর বাসায় পৌঁছে দিলে ৫০ টাকা বাড়তি ভাড়া। তিনি লাফস, জি গ্যাস এবং ওমেরা গ্যাসের ডিলার বলে জানান।

কিন্তু সরকারি দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করছেন কেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কোম্পানি থেকেই তাদেরকে বেশি দাম ধরছে।’

তবে ১২ কেজির বসুন্ধরা ও বেক্সিমকো কোম্পানির গ্যাস বিক্রি করছেন এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ২৫০ টাকা। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘তিনি এগুলোর ডিলার না, রিটেইলার। আর বাজারে বসুন্ধরা গ্যাসের সরবরাহ কম থাকার কারণে ডিলার পর্যায় থেকেই তাদের কাছে এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ১৫০ টাকায় বিক্রি করা হয়।’

মোহাম্মদপুর বসিলা এলাকার শাহিন এন্টারপ্রাইজ-১ এর মালিক শাহীন বলেন, ‘১২ কেজির এলপি গ্যাস বিক্রি করা হচ্ছে এক হাজার ২৫০ টাকা।

তবে একই এলাকার শাহিন এন্টারপ্রাইজ-২ কে সাংবাদিক পরিচয় দেওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এক হাজার ২২০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। কিন্তু বাসায় পৌঁছে দিলে ভাড়া বাবদ ৫০ টাকা বাড়তি নেওয়া হচ্ছে।’

একই অবস্থা জেলা শহরগুলোতেও। নরসিংদীর ইটাখোলা এলাকার এলপি গ্যাস বিক্রেতা মো. টুটুল মুঠোফোনে বলেন, ‘১২ কেজির এলপি গ্যাস বিক্রি করছেন এক হাজার ৫০ টাকা।’

সরকার ঘোষিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করছেন কেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কোম্পানি থেকেই কেনা পড়ছে।’

এছাড়াও গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকার এলপি গ্যাস বিক্রেতা রাজু আহমেদ বলেন, ‘১২ কেজির বোতলের গ্যাস এক হাজার ৫০ টাকায় বিক্রি করছি। তবে পৌঁছানোর গাড়ি ভাড়া যা খরচ যাবে, তাই দিতে হবে।’

অথচ খুচরা বিক্রেতার কমিশন আলাদা করে রেখেই এলপিজির মূল্য ঘোষণা করে আসছে বিইআরসি।

বিইআরসি ঘোষিত জুলাই মাসের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৯৯৯ টাকার মধ্যে ডিলারের কমিশন ৩৪ টাকা এবং খুচরা বিক্রেতার ৩৮ টাকা রয়েছে। সে হিসাবে খুচরা বিক্রেতাদের ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম সর্বোচ্চ ৯৬১ টাকা হওয়ার কথা।

কিন্তু ডিলাররাই বিইআরসি’র আদেশকে মানতে চাইছে না। তাদের বক্তব্য, আমরাও বিইআরসি নির্ধারিত দরে কিনতে পাচ্ছি না। আমাদের কাছ থেকেই বেশি দর নিচ্ছে আমদানিকারকরা। তাই বাধ্য হয়ে আমরাও বেশি দামে বিক্রি করছি।

বিইআরসি’র বিগত একাধিক দর ঘোষণার সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির হয়ে এলপিজি ডিস্ট্রিবিউটরদের সংগঠনের সভাপতি মো. সেলিম খান এর প্রতিকার চেয়ে আসছেন। গত ০২ এপ্রিল বিইআরসি ১২ কেজি সিলিন্ডারের দর ২৪৪ টাকা কমিয়ে এক হাজার ১৭৮ টাকা নির্ধারণ করে। সেলিম খান ওই সাংবাদিক সম্মেলনেই প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, আপনারা নতুন দর ঘোষণা করলেন। কিন্তু আমদানিকারকরা আজকে (০২ এপ্রিল) মিল গেটে ১২ কেজির দর ঘোষণা করেছে এক হাজার ২০০ টাকা। বিইআরসির হিসাব অনুযায়ী আমাদের (ডিস্ট্রিবিউটর) পাওয়ার কথা এক হাজার ১০৬ টাকা দরে। এরপর আমাদের কমিশন ৩৪ টাকা এবং খুচরা বিক্রেতার কমিশন ৩৮ টাকা ধরে ভোক্তা পর্যায়ে এক হাজার ১৭৮ টাকা হওয়ার কথা। অথচ আমাদের ৯৪ টাকা বেশি দরে কিনতে হচ্ছে। আমাদের পক্ষে এক হাজার ১৭৮ বিইআরসি ঘোষিত দরে বিক্রি করা সম্ভব নয়।

সে দিন অভিন্ন অভিযোগ করেছিলেন বাংলাদেশ এলপি গ্যাস ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির অর্থ সম্পাদক তাহের এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আবু তাহের কোরাইশী। ওমেরা এলপি গ্যাসের ওই ডিস্ট্রিবিউটর দাবি করেন, তাদের কোম্পানিও মিলগেটে এক হাজার ২০০ টাকা দর ঘোষণা করেছে। তাদের কমপক্ষে ৯০ টাকা কমিশন না হলে লোকসান দিতে হবে।

জবাবে বিইআরসি’র চেয়ারম্যান নুরুল আমিন সে দিন বলেছিলেন, আমরা বিষয়টি দেখবো। মালিকদের সঙ্গে বসে নির্ধারিত দরে বিক্রির বিষয়ে নিশ্চিত করা হবে। যদি কোনো মালিক কথা না শুনতে চায় তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এরপর এলপি গ্যাস আমদানিকারকদের সঙ্গেও বৈঠক করা হয়। সেই বৈঠকে নির্ধারিত দরে এলপি গ্যাস বিক্রির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বলে বিইআরসি সূত্র জানিয়েছে। তবে কার্যত তার কোনো প্রতিফলন হয়নি।

মালিকরাই বেশি দর নিচ্ছে এ বিষয়ে তার (বিইআরসি’র চেয়ারম্যান) দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘দর নির্ধারণ করার সময় মালিকদের প্রতিনিধি থাকেন। তাদের দাম বেশি নেওয়া কোনো ‍সুযোগ নেই। অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

২০২১ সালের ১২ এপ্রিল প্রথম এলপি গ্যাসের দর ঘোষণা করে বিইআরসি। তখন এলপিজি আমদানিকারক, ডিলার ও খুচরা বিক্রেতার জন্য ১২ কেজির সিলিন্ডারে মোট ৩৫৯ দশমিক ৪০ টাকা কমিশন নির্ধারণ করা হয়েছিল। দর ঘোষণার দিনেই কমিশনের পরিমাণ নিয়ে আপত্তি তোলে এলপি গ্যাস আমদানিকারকদের সংগঠন এলপিজি অপারেটরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব)। এরপর থেকে বিইআরসির সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হয় লোয়াবের।

তারা প্রতি মাসের দর ঘোষণাও বর্জন করে বিভিন্ন ভাবে বিইআরসি’র উপর চাপ তৈরি করে। এমনকি এলপি গ্যাস আমদানি বন্ধ করে দেওয়ারও হুমকি দেন লোয়াবের সভাপতি আজম জে চৌধুরী। বিইআরসি অনেকটা বাধ্য হয়ে সাত মাসের মাথায় ১০ অক্টোবর কমিশন ৩৫৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৪১ টাকা করেন। অর্থাৎ ১২ কেজি সিলিন্ডারে তখন কমিশন বাড়ানো হয়েছে ৮১ দশমিক ৬ টাকা। ডিলার ও খুচরা বিক্রেতাদের কমিশন বাড়িয়ে যথাক্রমে ৩৪ ও ৩৮ টাকা করা হয়েছে।

প্রথমবারের মতো এলপি গ্যাসের দর ঘোষণার সময় বলা হয়, যেহেতু পণ্যটি প্রায় ৯৮ শতাংশ আমদানির উপর নির্ভরশীল। সে কারণে সৌদি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি আরামকো ঘোষিত দরকে প্রতি মাসের ভিত্তি মূল্য ধরা হয়েছে। সৌদির দর উঠা-নামা করলে এলপি গ্যাসের মূল্যও উঠা-নামা করবে। আমদানিকারকের অন্যান্য কমিশন ও খরচ অপরিবর্তিত থাকবে।

-এসএম